আবার দেখা হবে কেমন!

প্ল্যান বাংলাদেশ আয়োজিত চাইল্ড পার্লামেন্টের এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে প্রথম দেখা। সে বসেছিল আমার একেবারে বিপরীতে। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল তার দৃষ্টি—এক ঝলকে চোখে চোখ। বুকের গভীরে কেঁপে উঠল এক অজানা অনুভূতি। মনে হলো, ওই চোখজোড়া যেন কোনো স্বর্গদূতের। কপালের ওপর ঢলে পড়া চুলগুলো তাকে করে তুলেছে আরও মোহময়।
অনুষ্ঠান শুরু হলেও মন পড়ে রইল ওর দিকেই। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল সেদিকে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় নিজেই যেন থমকে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কথা বলা হলো না। ভাগ্য সেদিন নিরুত্তর রইল।
তারপর একদিন, রংপুর শহরের এক গলিতে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি—সে আসছে একটি রিকশায়। আবারও চোখে চোখ পড়ল। এবার সে উপহার দিল এক মুচকি হাসি। ভালোবাসার কথা তখনো বলা হয়নি, তবুও হৃদয় ছিল পরিপূর্ণ অনুভবে। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম চুল ঠিক করতে, আর সে চলে গেল নিঃশব্দে—একটি বাতাস হয়ে।
এই শহরে প্রতিদিন হাজার মানুষের পদচারণা। তবুও মনে হতো, কোথাও না কোথাও সে আছে। হয়তো হঠাৎ করেই আবার দেখা হয়ে যাবে। ভালো লাগাটা ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছিল একতরফা ভালোবাসায়। বলা হয়নি কোনোদিন। প্রকাশ করা হয়নি অন্তরের ব্যাকুলতা। সে জানত না—একজন পাগলের মতো তাকে খুঁজে ফিরি প্রতিদিন।
যেমন মুদ্রার দুই পিঠ, তেমনি এই ভালোবাসারও ছিল এক বিপরীত সুর। সে হারিয়ে গেল হেমন্তের এক নেশাতুর বিকেল এনে—যেন কালবৈশাখীর ঝড় এসে কেড়ে নিল তাকে। আমি খুঁজেছি—শহরের অলিতে-গলিতে, ভিড়ে আর নির্জনতায়, কিন্তু কোথাও তার দেখা মেলেনি।
বহু বছর পর, একদিন বাসায় ফেরার পথে বাসে উঠে দেখি—সে বসে আছে জানালার পাশে। পাশের সিটটি খালি। মনে হলো, এবার বুঝি সৃষ্টিকর্তা আমার দীর্ঘ অপেক্ষার প্রতিদান দিতে চলেছেন। কিন্তু বসতে যেতেই সে বলল,
— “আমার বান্ধবী আসবে, আপনি সামনের সিটে বসুন।”
আমি থমকে গেলাম। বাসভর্তি মানুষের মাঝে নিজেকে হঠাৎ নগ্ন ও নগণ্য মনে হলো। চোখ নামিয়ে নিলাম। বুকের গভীরে বিদ্ধ হলো শত সহস্র ভালোবাসার বাণ। মনে হলো—বিধান রায়, ভালোবাসা হয়তো তোমার জন্য নয়।
অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। হয়তো সে বুঝেছিল আমার মনের অবস্থা। সে চাইলে জানতে পারত—“ভালোবাসো?” আমি হয়তো মুচকি হেসেই কোনো সিনেমার সংলাপ বলে দিতাম মনের কথা। কিন্তু সে কিছু বলল না।
বাস থেকে নামার সময় বান্ধবীকে নিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকাল সে। চাহনিটা ছিল দীর্ঘ। হঠাৎ মুচকি হেসে বলল—
— “০৫৫১। আবার দেখা হবে কেমন!”
আমি হতবাক হয়ে রইলাম। সে চলে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ না সে চোখের আড়ালে যায়। মনে হলো, “০৫৫১” যেন একটি চার অঙ্কের ধাঁধা, একটি অপেক্ষা, একটি না বলা কথার সংকেত।
তারপর কেটে গেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। জীবনের ব্যস্ততা টেনে নিয়েছে ভিন্ন পথে। তবুও একান্ত নির্জনে মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে সেই চোখজোড়া, সেই হাসি আর সেই রহস্যময় সংখ্যা— “০৫৫১”একটি চিরন্তন অপেক্ষার নাম।
✍️ বিধান চন্দ্র রায়, রংপুর।