জ্বলন্ত মাঠে কৃষক: হিট ওয়েভে টিকে থাকার লড়াই

May 17, 2025 - 18:09
জ্বলন্ত মাঠে কৃষক: হিট ওয়েভে টিকে থাকার লড়াই
ছবিঃ সংরক্ষিত

বাংলাদেশের কৃষক এখন মাঠে শুধু ফসলের সঙ্গে লড়ছেন না—লড়ছেন তাপপ্রবাহ নামের এক নিরব অথচ ভয়ংকর দুর্যোগের সঙ্গে। ২০২৫ সালের গ্রীষ্ম যেন আগুন ছুঁড়ে দিচ্ছে আকাশ থেকে। দেশের ৪৫টিরও বেশি জেলা এখন একাধিক ধাপের হিট ওয়েভে আক্রান্ত। কোথাও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। এই ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে মাঠের শস্যে, খামারের পশুতে, এমনকি কৃষকের শরীরেও। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের কৃষকদের দরকার সঠিক সিদ্ধান্ত, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও সময়োচিত প্রস্তুতি।

পানি ব্যবস্হাপনায় বুদ্ধিমত্তা 

তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পানির সংকট। অতিরিক্ত গরমে পানি দ্রুত বাষ্প হয়ে যায়, ফলে ফসলের শিকড়ে পানির জোগান কমে যায়। কৃষকদের উচিত সেচ দেওয়া সময়টা পরিবর্তন করা—সকালে ভোরে বা সন্ধ্যার পর সেচ দিলে পানির অপচয় কম হবে এবং শেকড়ে তা বেশি সময় ধরে থাকবে। পাশাপাশি ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রে সেচ ব্যবস্থার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় যেখানে উপযোগী।

মালচিং ও ছায়া ব্যবস্হাপনা

খোলা মাঠে সূর্যের প্রখরতা ফসলের উপর সরাসরি আঘাত হানে। তাই জমির মাটির উপরে খড়, শুকনো পাতা বা প্লাস্টিক দিয়ে মালচিং করলে তা একদিকে আর্দ্রতা ধরে রাখে, অন্যদিকে গাছকে তাপের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা করে। ক্ষেত্রবিশেষে ছায়া তৈরি করে এমন গাছ বা কাঠামো ব্যবহার করাও ফলপ্রসূ।

গবাদিপশুর নিরাপত্তা 

গরমে মানুষ যেমন কাহিল হয়, তেমনি গবাদিপশুর শরীরেও দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন, খাদ্যে অনীহা, এমনকি হিট স্ট্রোক। তাই গরু-ছাগলের ঘর যেন খোলামেলা, ছায়াযুক্ত ও ঠাণ্ডা হয় তা নিশ্চিত করা জরুরি। দিনে দু’বার ঠাণ্ডা পানি পান করানো ও প্রয়োজনে গায়ে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দেওয়া পশুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

ফসল নির্বাচনে অভিযোজন

হিট ওয়েভের সময় তাপ সহনশীল জাত বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন BRRI dhan67 একটি তাপসহনশীল ধানের জাত। পাশাপাশি, শাকসবজি হিসেবে কুমড়া, ঢেঁড়স, পাটশাকের মতো গরম সহ্য করতে পারে এমন ফসলকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে ঝুঁকি কমে এবং কৃষক কিছুটা হলেও লাভবান হতে পারেন।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার

আজকের কৃষি কেবল হালের ও লাঙলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর, কৃষি অফিস কিংবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিনের তাপমাত্রা, পূর্বাভাস ও পরামর্শ জানা সম্ভব। অনেক কৃষি সেবা অ্যাপ যেমন “Krishi Batayon” বা “Digital Krishoker Janala” এখন স্মার্টফোনেই কৃষকের হাতের মুঠোয়।

আর্থিক সহায়তা ও সচেতনতা

তাপপ্রবাহে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে কৃষকদের মধ্যে ফসল বিমা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। অধিকাংশ কৃষক জানেনই না, তারা চাইলে কম খরচে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষতির বিমা করতে পারেন। পাশাপাশি ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় হয়ে মাঠে ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

এই লড়াই শুধু একজন কৃষকের একার নয়। এটি একটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিপ্রধান অর্থনীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। তাপপ্রবাহ থামবে না—বরং আগামী বছরগুলোতে আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। কিন্তু আমরা যদি এখনই প্রস্তুত হই, আধুনিক কৃষি কৌশল ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেই, তবে এই আগুনেও ফসল ফলবে। মাঠে সবুজ থাকবে, কৃষক হাসবে, দেশ এগোবে।

✍️ওয়াহিম হোছাইন চৌধুরী,

কৃষি বিশ্লেষক ও যুব সংগঠক।